তরুণ প্রকৌশলীদের জন্য সোনালী সুযোগ সৃষ্টি করছে বি-জেট সেন্টার
বাংলাদেশের তরুণ প্রকৌশলীদের জাপানের কর্মবাজারের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও জাপানের মিয়াজাকি ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বি-জেট (বাংলাদেশ-জাপান আইটি) সেন্টার। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই পরিচালিত এই কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা জাপানের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য বৈশ্বিক সুযোগ
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী এই উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন,
"আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক কর্মবাজারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বি-জেট সেন্টার বাংলাদেশের কম্পিউটার প্রকৌশল ও আইসিটি খাতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উন্নত প্রযুক্তির দেশ জাপানের কর্মবাজারের জন্য দক্ষ করে তুলছে। এর ফলে আমাদের তরুণ প্রকৌশলীরা জাপানের বিভিন্ন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করতে পারছে। আমরা বৈশ্বিক মানের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
বি-জেট সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সফল ক্যারিয়ার
বি-জেট প্রোগ্রাম থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেকেই জাপানের প্রযুক্তি শিল্পে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন এস এম ইশতিয়াক আহমেদ। তিনি ২০২১ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং এখন জাপানের মিয়াজাকি শহরে একজন ফুল-স্ট্যাক ডেভেলপার হিসেবে কাজ করছেন।
ইশতিয়াক আহমেদ তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন,
"আমি এখন জাপানে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের ফ্রন্টএন্ড ও ব্যাকএন্ড নিয়ে কাজ করছি। বি-জেট ট্রেনিং থেকে আমি জাপানের কর্মসংস্কৃতি, ভাষাগত দক্ষতা ও ব্যবসায়িক যোগাযোগের শিষ্টাচার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছিলাম। জাপানের অফিসের সময়নিষ্ঠতা ও পেশাদারিত্ব সম্পর্কে যে ধারণা বি-জেট আমাকে দিয়েছিল, তা এখন আমার বাস্তব জীবনে বেশ কাজে লাগছে।"
বি-জেট প্রোগ্রামে কীভাবে আবেদন করবেন?
জাপানের কর্মবাজারে প্রবেশ করতে হলে ন্যূনতম জাপানি ভাষার দক্ষতা প্রয়োজন। বি-জেট প্রোগ্রাম থেকেই প্রাথমিক ভাষাগত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
এই প্রোগ্রামে প্রতি বছর ৮০ জন বাংলাদেশি প্রকৌশলী অংশগ্রহণের সুযোগ পান। প্রশিক্ষণ মোট ৮ মাসব্যাপী চলে, যার প্রথম ৫ মাস ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে এবং পরবর্তী ৩ মাস জাপানের মিয়াজাকি ইউনিভার্সিটিতে উন্নত প্রশিক্ষণ (অ্যাডভান্সড ট্রেনিং) পরিচালিত হয়।
বি-জেট প্রোগ্রামের সমন্বয়ক ইউকি মরিশিতা বলেন,
"জাপানের বড় শহরগুলোতে দক্ষ আইটি পেশাজীবীদের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জন্য জাপানের কর্মবাজারে প্রচুর সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আমরা এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি শেখানোর পাশাপাশি, কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাও দিচ্ছি।"
বি-জেট থেকে ক্যারিয়ার গড়া তরুণদের অভিজ্ঞতা
বি-জেট প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইতোমধ্যে অনেক তরুণ প্রকৌশলী জাপানের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত আছেন।
বি-জেটের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মীর ফায়েক হোসেন ছোটবেলা থেকেই জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা) থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক শেষ করার পর বি-জেট ট্রেনিং গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি জাপানের স্কাইকম নামের একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন।
আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. জাহিদ হক ২০২৩ সালের অক্টোবরে বি-জেট প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি জাপানের টোকিওতে কিকুয়া বিশোডো নামক একটি প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তার ভাষ্যমতে,
"বি-জেট থেকে আমি শিখেছি কীভাবে জাপানি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে হয়, কিভাবে সঠিকভাবে সিভি প্রস্তুত করতে হয়। এই প্রশিক্ষণ আমার ক্যারিয়ার গঠনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে।"
আবেদনের যোগ্যতা ও প্রক্রিয়া
বি-জেট সেন্টারে ক্লাস অনলাইন ও অফলাইন উভয় মাধ্যমেই পরিচালিত হয়।
যেসব শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে চান, তাদের জন্য আবশ্যক যোগ্যতাগুলো হলো—
✔ কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি থাকা প্রয়োজন।
✔ প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, এআই বা মেশিন লার্নিংয়ের কাজে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
✔ আধুনিক প্রোগ্রামিং ভাষা সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে।
✔ সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং নতুন প্রযুক্তি শেখার আগ্রহ থাকতে হবে।
✔ ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতে হবে এবং জাপানি ভাষা শেখার আগ্রহ থাকতে হবে।
বি-জেট সেন্টার শুধু প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, বরং তরুণদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কর্মসংস্থানের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক মেধাবী প্রকৌশলী এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে জাপানের প্রতিষ্ঠিত আইটি কোম্পানিগুলোতে চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন।
জাপানে ক্যারিয়ার গড়তে বি-জেট প্রোগ্রাম কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চান, বিশেষ করে আইটি ও প্রযুক্তি খাতে। তবে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত বাধার কারণে অনেকেই এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন না। বি-জেট প্রোগ্রাম এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে।
এই কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা:
✔ জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি শেখার সুযোগ পান।✔ প্রোগ্রামিং ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে উন্নত প্রশিক্ষণ লাভ করেন।✔ জাপানের কর্পোরেট সংস্কৃতিতে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা অর্জন করেন।✔ প্রতিষ্ঠিত জাপানি কোম্পানিতে সরাসরি চাকরির সুযোগ পান।
বি-জেট সেন্টারের প্রধান লক্ষ্যসমূহ:
১) বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের বৈশ্বিক কর্মবাজারের জন্য প্রস্তুত করা
- প্রোগ্রামিং ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া।
- আইটি ও প্রযুক্তি খাতে আধুনিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করা।
- আন্তর্জাতিক মানের প্রকৌশলী তৈরির জন্য হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
২) জাপানের কর্মসংস্থানের উপযোগী দক্ষতা প্রদান
- জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে চাকরিপ্রার্থীরা সহজে জাপানের অফিস পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারেন।
- জাপানের কর্পোরেট ওয়ার্ক কালচার ও ব্যবসায়িক শিষ্টাচার শেখানো।
- জাপানি কোম্পানির প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষতা তৈরি করা।
৩) বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জাপানে চাকরির সুযোগ তৈরি করা
- জাপানের আইটি কোম্পানিগুলোর সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা।
- প্রকৌশলীদের দক্ষতা অনুযায়ী জাপানি কোম্পানিতে চাকরির সুপারিশ করা।
- নিয়মিত ইন্টার্নশিপ ও জব প্লেসমেন্টের সুযোগ দেওয়া।
৪) দেশের প্রযুক্তিখাতকে আরও উন্নত করা
- বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জন্য আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো।
- দেশের আইটি ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাকে বিশ্বমানের করার জন্য কাজ করা।
- জাপান-বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা।
৫) শিক্ষার্থীদের পেশাদারিত্ব ও ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট নিশ্চিত করা
- আধুনিক প্রোগ্রামিং ভাষা ও সফটওয়্যার উন্নয়নের প্রশিক্ষণ প্রদান।
- সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও টিমওয়ার্ক শেখানো।
- ক্যারিয়ার গঠনের জন্য সিভি লেখা, ইন্টারভিউ কৌশল ও চাকরির প্রস্তুতি বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া।
ভবিষ্যতে বিস্তৃত হবে বি-জেট প্রোগ্রাম
বি-জেট প্রোগ্রামের আয়োজকরা জানিয়েছেন, আগামীতে আরও বেশি বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জন্য এই প্রোগ্রামটির সুযোগ প্রসারিত করা হবে। নতুন ব্যাচের আবেদন শীঘ্রই শুরু হবে, যা শিক্ষার্থীদের একটি সুদূরপ্রসারী ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
যারা বিদেশে কাজ করতে চান এবং জাপানে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী, তাদের জন্য বি-জেট প্রোগ্রাম নিঃসন্দেহে একটি বড় সুযোগ।
সর্বশেষ তথ্য ও আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে
বি-জেট প্রোগ্রামের আবেদন প্রক্রিয়া ও সময়সূচী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ও বি-জেট সেন্টারের অফিসিয়াল নোটিশ থেকে পাওয়া যাবে। আগ্রহীরা তাদের ক্যারিয়ার গঠনের লক্ষ্যে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারেন এবং এই আন্তর্জাতিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
বি-জেট সেন্টারের মতো উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের তরুণদের বৈশ্বিক কর্মবাজারে প্রবেশের দ্বার খুলে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের উদ্যোগ আরও বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের জায়গা আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।