পাওনা ৫.৮ ট্রিলিয়ন ডলার তবুও ঋণের ফাঁদে বাংলাদেশ
ধনী ও জলবায়ু দূষণকারী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনাদার। কিন্তু এই অর্থ পরিশোধের পরিবর্তে, উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশকে উন্নয়নের নামে প্রায় ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদেশি ঋণের বোঝায় জর্জরিত করছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড-এর প্রকাশিত একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বিদেশি ঋণ দ্রুত প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত আফ্রিকান ইউনিয়নের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ‘হু ওজ হু’ নামের এই বিশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল।
বিশ্বব্যাপী নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক ঋণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের নামে উন্নত দেশগুলো এসব দেশে ঋণের ফাঁদ সৃষ্টি করলেও জলবায়ু দূষণের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড-এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ নিম্ন আয়ের দেশগুলোর কাছ থেকে ধনী দেশগুলো বিপুল পরিমাণ ঋণের অর্থ আদায় করছে, অথচ জলবায়ু সংকটের ক্ষতিপূরণ বাবদ তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে না।
বৈদেশিক ঋণের চাপে নিম্ন আয়ের দেশ
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বের ৫৪টি নিম্ন আয়ের দেশ বৈদেশিক ঋণের চাপে জর্জরিত। এই দেশগুলো নিজেদের জাতীয় উন্নয়নকে সংকুচিত করে ধনী দেশগুলোর কাছে ১৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে। উন্নয়নের নামে এই ঋণের বোঝা তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে এবং সরকারি সেবাসমূহে ব্যয় কমাতে বাধ্য করছে।
জলবায়ু ঋণের বাস্তবতা
সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, জলবায়ু দূষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর কাছে ১০৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণী ধনী দেশগুলো। এই পরিমাণ ঋণ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর বৈদেশিক ঋণের তুলনায় ৭০ গুণ বেশি। সমীক্ষায় অন্তত ৭০টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেখানে উঠে এসেছে ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি না রাখার প্রবণতা।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে:
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ: ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জলবায়ু ক্ষতিপূরণ পাওনা:
১৯৯২ সাল থেকে নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী ৫.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১৯৬০ সাল থেকে হিসাব করলে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৭.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিদেশি ঋণ পরিশোধ: ২০২৩ সালে বাংলাদেশ মোট ৪.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে।
জাতীয় রাজস্ব ব্যয়: ২০০৪ সালের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্বের ১৬.৯ শতাংশ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে, যেখানে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশ এবং শিক্ষাখাতে ১১.৭৩ শতাংশ।
ধনী দেশগুলোর দায়বদ্ধতা
একশনএইড-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনী দেশগুলো, আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এবং বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থাগুলোর ঋণ পরিশোধের চাপে বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ জলবায়ু সংকটের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
ঋণ সংকট ও জলবায়ু ন্যায়বিচার
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, "এই প্রতিবেদন নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ঋণের ফাঁদের বাস্তবতা তুলে ধরেছে। ধনী দেশগুলোর জলবায়ু ক্ষতিপূরণ পরিশোধে ব্যর্থতার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হয়েছে।" তিনি আরও বলেন, "ঋণ সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের উচিত বৈদেশিক ঋণ প্রত্যাহারের দাবি তোলা এবং ঔপনিবেশিক ঋণ কাঠামো থেকে মুক্তির জন্য কাজ করা।"
নারীদের ওপর জলবায়ু সংকটের প্রভাব
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ছে। ফারাহ্ কবির বলেন, "আমরা বারবার দেখেছি কীভাবে নারী ও মেয়েরা জলবায়ু সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। অথচ ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুত জলবায়ু ঋণ পরিশোধ না করার ফলে প্রশমন ও অভিযোজন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।"
কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান
প্রতিবেদনে বিশ্ব নেতাদের কাছে নিম্নলিখিত দাবি জানানো হয়েছে:
- বৈদেশিক ঋণের চাপ কমানোর জন্য নতুন জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন প্রতিষ্ঠা করা।
- নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য বৈশ্বিক ঋণ মওকুফের উদ্যোগ নেওয়া।
- জলবায়ু ক্ষতিপূরণ বাবদ ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত পরিশোধ করা।
- ঋণদাতা দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরও নৈতিক ও দায়িত্বশীল ঋণ প্রদানের নীতি নির্ধারণ।
উপসংহার
বাংলাদেশসহ অন্যান্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক ঋণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে, ধনী দেশগুলোর জলবায়ু ক্ষতিপূরণ পরিশোধে ব্যর্থতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। একশনএইড-এর প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে বৈষম্য রয়ে গেছে। এটি দূর করার জন্য বিশ্বনেতাদের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।