হিমবাহ গলছে, বিশ্ববাসী উদ্বেগে

Glacier melting
AI Photo


বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম সুস্পষ্ট লক্ষণ হলো হিমবাহ গলার হার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত দুই দশকে হিমবাহ গলার হার অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে এই শতকের শেষ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পূর্বানুমানের চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বৈশ্বিক পরিবেশ, অর্থনীতি এবং মানবজীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

গবেষণার মূল তথ্য

সম্প্রতি প্রকাশিত "নেচার" সাময়িকীর গবেষণাপত্র অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে যে পরিমাণ হিমবাহ গলেছে, তার তুলনায় ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ৩৬% বেশি হিমবাহ গলেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, ছোট ও মাঝারি আকারের হিমবাহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড গ্লেসিয়ার মনিটরিং সার্ভিস (WGMS), এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আর্থওয়েভ-এর গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ২৭,৩০০ কোটি টন বরফ গলছে, যা বিশ্ববাসীর ৩০ বছরে ব্যবহৃত পানির সমান।

অঞ্চলভেদে হিমবাহ গলার হার

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে হিমবাহ গলার হার একরকম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে:

  • অ্যান্টার্কটিকা: এখানে মোট হিমবাহের ২% গলে গেছে।
  • গ্রিনল্যান্ড: বরফের বিশাল চাদরগুলো দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে, গত ৩০ বছরে ক্ষয়ের হার ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • ইউরোপীয় আল্পস: ৪০% পর্যন্ত হিমবাহ ইতোমধ্যে গলে গেছে।
  • হিমালয় ও কারাকোরাম পর্বতমালা: এই অঞ্চলের হিমবাহের দ্রুত গলন এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের পানির উৎসকে হুমকির মুখে ফেলছে।
  • আন্দিজ পর্বতমালা: দক্ষিণ আমেরিকার এই অঞ্চলে হিমবাহ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, যা কৃষি ও পানি সরবরাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

হিমবাহ গলার কারণ

বিজ্ঞানীরা হিমবাহ গলার প্রধান কারণ হিসেবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂), মিথেন (CH₄) এবং নাইট্রাস অক্সাইড (N₂O) গ্যাসের ব্যাপক নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, যা হিমবাহ গলার অন্যতম প্রধান কারণ।

পরিবেশগত প্রভাব

হিমবাহ গলার ফলে নানা ধরনের পরিবেশগত পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে।

  • সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: হিমবাহ গলার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বন্যা ও ভূমিক্ষয়ের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।
  • আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন: বরফের স্বাভাবিক প্রতিফলন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা আরও বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি: হিমবাহ গলার ফলে হিমবাহ হ্রদ বিস্ফোরণ (GLOF) এর সংখ্যা বাড়ছে, যা হিমালয় অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার কারণ হতে পারে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

হিমবাহ গলার ফলে জলবায়ুগত পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

  • খাদ্য উৎপাদনে সমস্যা: হিমবাহের গলন থেকে সৃষ্ট নদীগুলোর পানির প্রবাহ কমে গেলে কৃষির জন্য পানি সংকট তৈরি হতে পারে।
  • জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাঘাত: হিমবাহ থেকে উৎপন্ন নদীগুলো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অপরিহার্য। হিমবাহ গলার কারণে অনেক দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকটে পড়তে পারে।
  • মানব বাস্তুচ্যুতি: উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে।

হিমবাহ সংরক্ষণের উপায়

বিশ্বের হিমবাহগুলো রক্ষা করতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

  • গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো: নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস করা।
  • পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ: শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রচলন বাড়ানো।
  • বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

উপসংহার

হিমবাহ গলা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ভয়াবহ সংকেত। এর প্রভাব শুধু পরিবেশের ওপর নয়, মানবজাতির অস্তিত্বের ওপরও পড়ছে। সময় থাকতে যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। তাই এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হবে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সবাইকে সচেতন হতে হবে।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url